১। আশা কুচিয়ামোড়া বাজার, কর্মকর্তা ১ জন, কর্মচারী ৮ জন ।
২। দিশা গ্রাম: বাশেঁরদিয়াড়, কর্মকর্তা ১ জন, কর্মচারী ৭ জন ।
৩। স্বদেশ কুচিয়ামোড়া বাজার কর্মকর্তা ১ জন, কর্মচারী ১৩ জন । মোবা: ০১৭১৫৩৫১২৩৮ ।
৪। এডো কুচিয়ামোড়া বাজার কর্মকর্তা ১ জন, কর্মচারী ৮ জন ।
১। গ্রামীন ব্যাংক কুচিয়ামোড়া বাজার কর্মকর্তা ১ জন, কর্মচারী ১০ জন ।
বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠন সাধারণভাবে, সরকার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত নয় এমন যে কোনো সংস্থাই বেসরকারি সংগঠন বা এনজিও। তবে বিগত তিন দশকে এনজিও কার্যক্রমের ধারা থেকে বর্তমানে এনজিও-র যে রূপ দাঁড়িয়েছে তাতে বলা যায় এনজিও হচ্ছে উন্নয়ন কর্মকান্ডে নিয়োজিত অমুনাফাভিত্তিক এক ধরনের বিশেষ স্বেচ্ছাসেবী সামাজিক সংগঠন।
এনজিও-র আওতায় পড়ে অনানুষ্ঠানিক বিভিন্ন সমিতি, সীমিত দায়ের আনুষ্ঠানিক সমবায় সমিতি এবং নিবন্ধিত বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা। উন্নয়ন-এনজিও নামেও একটি ধারণা গড়ে উঠেছে। এগুলি গ্রাম ও শহর এলাকার দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য নানা কার্যক্রম পরিচালনা করে। এ জাতীয় প্রতিষ্ঠানকে অনেকে বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী উন্নয়ন সংস্থা বা শুধু স্বেচ্ছাসেবী উন্নয়ন সংস্থা নামে অভিহিত করে। এদের কার্য তালিকায় থাকে উন্নয়নের আর্থ-সামাজিক নানা কার্যক্রমসহ পরামর্শ সেবা, আইনি সহায়তা ও ত্রাণ তৎপরতা।
বিশ শতকের শেষভাগে অনেক উন্নয়নশীল দেশে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাসমূহের দ্রুত সংখ্যা বৃদ্ধি ও এদের কার্যক্রমের সম্প্রসারণ ঘটেছে। সমাজ কল্যাণে ও উন্নয়ন কর্মকান্ডে সরকারি তৎপরতার পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগের যে একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পূরক ভূমিকা আছে তার উপলব্ধি থেকেই এ নতুন ধারার সৃষ্টি হয়েছে। ১৯৫০-এর দশকে বাংলাদেশে এনজিওগুলির প্রাথমিক ও প্রধান কাজ ছিল ত্রাণ, পুনর্বাসন এবং দাতব্য কার্যক্রম পরিচালনা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে এ এনজিওগুলি কমিউনিটি উন্নয়নের মাধ্যমে পুনর্নির্মাণের নতুন ধারণা নিয়ে কাজ শুরু করে। বিশ শতকের ষাটের ও সত্তরের দশকে এসে এনজিওগুলি ঋণ সমিতি, সমবায় সমিতি ইত্যাদি ও কমিউনিটি-ভিত্তিক বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প গড়ে তুলতে শুরু করে এবং উন্নয়নের জন্য সমষ্টিগত উদ্যোগের চেয়ে ব্যষ্টিক উদ্যোগের ওপর অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করে। বর্তমান এনজিওসমূহের অধিকাংশই এখন কৃষি সংস্কার ও পল্লী উন্নয়ন কর্মকান্ডে নিয়োজিত। এদের অধিকাংশই সৃষ্টি হয়েছে ১৯৮০-র দশকে এবং এরা নানা ব্যষ্টিক কার্যক্রমের সঙ্গে পরিবেশ,
বৈদেশিক সহায্য ও ঋণ, অবকাঠামোগত সংস্কার ইত্যাদি সমষ্টিগত বিষয় সমন্বয় করে কৃষি, পল্লী উন্নয়ন, সামগ্রিক প্রবৃদ্ধি ও বিকাশের সর্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে।
তিন পর্যায়ের এনজিও আন্দোলন থেকে বোঝা যায়, তারা বিভিন্ন সময়ে বিদ্যমান পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে নিজস্ব কার্যক্রম ও কার্যপদ্ধতির অনুসরণকারী। এনজিওসমূহের অনেকগুলিই প্রাথমিক, আবার কিছু কিছু মাধ্যমিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে। এসব সংস্থায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কাজ করে পেশাদার কর্মকর্তা-কর্মচারী, তবে কোনো কোনোটিতে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতেও অনেক লোক কাজ করে থাকে। বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনা করছে এমন অনেক এনজিও-র জন্ম বা উৎস উন্নত দেশগুলিতে এবং তাদের অর্থসম্পদও অনেক বেশি। তবে দেশের বেশির ভাগ এনজিও-ই স্থানীয় এবং এরা সীমিত সম্পদ নিয়েই কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে। বাংলাদেশে বর্তমানে যে উন্নয়ন-কৌশল অনুসরণ করা হচ্ছে তার তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি হচ্ছে দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্য, সুবিধার সুষম বণ্টন এবং উন্নয়নে জনগণের অংশগ্রহণ। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার পুনর্বিন্যাস, জাতীয় উন্নয়ন প্রয়াস ও কর্মকান্ডসমূহে গ্রামীণ সকল এলাকার পূর্ণতর ঐকাত্ম্যকরণ, গ্রামীণ এলাকায় অধিকতর কর্মসংস্থান ও উপার্জনের সুযোগ সৃষ্টি এবং কৃষক সমিতি, সমবায় সমিতি ও প্রাথমিক উৎপাদনকারী ও গ্রামীণ শ্রমিকদের স্বায়ত্তশাসিত স্বেচ্ছাসেবী গণতান্ত্রিক নানা সংগঠনের বিকাশ। গ্রামীণ এলাকার সব সমস্যা এত ব্যাপক ও জটিল যে জনগণের পূর্ণ সমর্থন ও অংশগ্রহণ ছাড়া সরকার বা কোনো রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার পক্ষে সেগুলির সমাধান প্রায় অসম্ভব। এর অর্থ, সরকারি উন্নয়ন-উদ্যোগ যথাযথ বাস্তবায়িত হবার জন্য জনগণের দ্বারা গঠিত সংস্থা-সংগঠনের সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রয়োজন। সাধারণভাবে এনজিও নামে পরিচিত এসব সংস্থার মধ্যে আছে বিভিন্ন ধরনের সমবায় সমিতি, ইউনিয়ন, কৃষক সমিতি, শ্রমিক সমিতি, মহিলা সমিতি ও অন্যান্য বেসরকারি সমিতি-সংগঠন।
দারিদ্র্য দূরীকরণ ও পল্লী উন্নয়নের লক্ষ্য নিয়ে কর্মরত স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাসমূহকে মোটামুটি তিন শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায়। ভৌগোলিক বিবেচনায় শ্রেণিকৃত প্রথম ধরনের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার মধ্যে অনেকগুলি আছে যাদের কর্মকান্ড স্থানীয় কিছু এলাকায় সীমিত। এগুলি আয়তনে ছোট, এদের সম্পদ সীমিত এবং ব্যবস্থাপনা-কাঠামো সরল। কয়েকটি গ্রাম বা উপজেলাতেই এদের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ। একই শ্রেণির অনেক এনজিও বস্ত্তত আঞ্চলিক বা উপ-আঞ্চলিক বা জাতীয় সংস্থারূপে বিন্যাসিত এবং এদের কার্যক্রম সীমিতসংখ্যক গ্রাম ছাড়িয়ে এবং বা একাধিক জেলায় বা বিভাগে, এমনকি সারা দেশব্যাপী বিস্তৃত। কার্যক্রমের ক্ষেত্র বিবেচনায় দেখা যায় কোনো কানো স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা কৃষি, পশুসম্পদ, ক্ষুদ্র শিল্প, সেচ, বনায়ন, স্বাস্থ্য ইত্যাদি বিভিন্ন খাতের কোনো একটি বা কয়েকটি খাতে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। আবার অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা কয়েকটি খাতের সমন্বিত কার্যক্রম চালাচ্ছে। এভাবেই, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলির কোনোটি স্বাস্থ্য সংগঠন, কোনোটি কৃষি সংগঠন, কোনোটি শিক্ষা সংগঠন ইত্যাদি। বেশ কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন পরিবেশ বা মহিলাবিষয়ক কর্মসূচিতে নিয়োজিত থাকায় বা বিশেষায়নের কারণে সংশ্লিষ্ট বিষয়-নামে বা শ্রেণিরূপে চিহ্নিত। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলিতে শ্রেণিকরণের তৃতীয় একটি ভিত্তি হচ্ছে এসব সংস্থা যাদের জন্য কার্যক্রম পরিচালনা করে সে লক্ষ্যকৃত গোষ্ঠী। বস্তিবাসীদের জন্য এনজিও, গ্রামীণ বেকারদের জন্য এনজিও, মাদকাসক্ত পুনর্বাসনের জন্য এনজিও ইত্যাদি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এভাবেই গঠিত।
বাংলাদেশে এনজিওসমূহের সৃষ্টি ও তাদের কর্মতৎপরতার শুরু হয় ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের পরপরই। এসব সংস্থার প্রধান কাজ ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির ত্রাণ ও পুনর্বাসনে সার্বিক সহযোগিতা দান। একসময় ত্রাণ ও পুনর্বাসন কাজ কমে এলে এসব সংস্থার অনেকগুলিই গ্রামীণ দরিদ্র জনগণের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে সাহায্য দানের কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে আসে। এভাবেই দেশে উন্নয়নে অংশীদারিত্বের একটি নতুন ধারা সৃষ্টি হয়। এনজিওগুলি এখন প্রধান যেসব ক্ষেত্রে কার্যক্রম পরিচালনা করছে সেগুলি হচ্ছে দারিদ্র্য বিমোচন, পল্লী উন্নয়ন, লৈঙ্গিক সমতা, পরিবেশ প্রতিরক্ষা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং মানবাধিকার। বাংলাদেশে এনজিওসমূহের সংখ্যা ও কর্মতৎপরতার ব্যাপক বৃদ্ধির একটি অন্যতম কারণ হচ্ছে দারিদ্র্য সমস্যার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সরকারের সীমাবদ্ধতা। তবে দেশে এখন কতটি এনজিও কাজ করছে তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। এনজিও নিবন্ধনের জন্য কয়েকটি সরকারি সংস্থা পাশাপাশি কাজ করছে। আবার অনেক এনজিও একাধিক সংস্থা কর্তৃক নিবন্ধিত। নিবন্ধনের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলির তথ্য ব্যবস্থাপনা দুর্বলতা শুধু এনজিওগুলির সংখ্যা-সংক্রান্ত তথ্যের যথার্থতা নিরূপণেই সমস্যা নয়, এনজিওগুলির কার্যক্রম মূল্যায়নের ক্ষেত্রেও এই দুর্বলতা বড় প্রতিবন্ধক।
বাংলাদেশের যেসব এনজিও বিদেশি উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহ করতে আগ্রহী তাদের জন্য বাংলাদেশ সরকারের এনজিও-বিষয়ক ব্যুরো-তে নিবন্ধিত হওয়া আইনত বাধ্যতামূলক। এ ব্যুরো ১৯৯০ সালে গঠিত এবং এটি প্রধান মন্ত্রীর কার্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত। ২০০৯-এর জানুয়ারি অবধি ব্যুরো মোট ২,৪৮৪টি এনজিও-কে নিবন্ধন দিয়েছে। এ পর্যন্ত ব্যুরো এসব এনজিওসমূহকে ৪.২ বিলিয়ন টাকার সমপরিমান অর্থ ব্যয় করার অনুমতি দিয়েছে। বাংলাদেশে এনজিওসমূহ সমন্বয়কারী বেশ কয়েকটি সংস্থা রয়েছে। প্রথমদিকে এগুলির মধ্যে বৃহত্তম সংগঠন হিসেবে অ্যাডাব কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিল। তবে সাম্প্রতিককালে অ্যাডাবের কর্মতৎপরতা হ্রাস পেয়েছে এবং আরো কিছু সংগঠন আত্মপ্রকাশ করেছে। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ফেডারেশন অব এনজিওস ইন বাংলাদেশ (এফএনবি)।
নানারকম পরীক্ষামূলক ও উদ্ভাবনী পদক্ষেপ এবং কার্যক্রমগত পদ্ধতি প্রয়োগের কারণে বাংলাদেশের অনেক এনজিও সমগ্র বিশ্বে পরিচিতি অর্জন করেছে। প্রশিকা, ব্র্যাক ও আশা বাংলাদেশে ক্ষুদ্রঋণ, উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা এবং প্রাথমিক চিকিৎসা-সেবার ক্ষেত্রে যেসব সফল মডেল প্রয়োগ করে আসছে সেগুলি এখন অনেক উন্নয়নশীল দেশেই প্রয়োগের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি বিশেষ বিশেষ ইস্যুতে ও সাধারণভাবে নীতি ও কৌশল প্রণয়নে এনজিওসমূহ সরকারের পরামর্শক ও দেন-দরবারকারীর ভূমিকায় উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে। এনজিওদের চেষ্টা ও অব্যাহত চাপে সরকার দরিদ্র জনগণের জন্য এবং পরিবেশ উন্নয়নে সহায়ক হয় এমন সব নীতি, পরিকল্পনা ও প্রকল্প গ্রহণে বাধ্য হচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গঠিত শিক্ষা কমিশন ও স্থানীয় সরকার কমিশনকে এনজিওগুলি যথেষ্ট সহায়তা দিয়েছে।
স্থানীয় সরকার নির্বাচনের সময়সূচি ও পদ্ধতি সম্পর্কে জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধিতে এবং কৃষি, খাসজমি বিতরণ ইত্যাদি বিষয়ক নীতি প্রণয়নে এনজিওগুলি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে।
বাংলাদেশে কোনো এনজিও বা সাধারণভাবে কোনো বেসরকারি সমিতি-সংগঠনের জন্য নিবন্ধন বাধ্যতামূলক নয়। তবে নিবন্ধনের মাধ্যমে এ জাতীয় সংগঠন বৈধ বলে স্বীকৃতি পায়। দেশে এনজিওসমূহ নিয়ন্ত্রণের যেসব আইন আছে সেগুলিকে মোটামুটি দু ভাগে ভাগ করা যায়: ১. স্বেচ্ছাসেবী ও বেসরকারি সমিতিসমূহকে বৈধ বলে স্বীকৃতি দেওয়ার আইন, ২. এ সকল সমিতির সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণ-সংক্রান্ত আইন। প্রথমোক্ত ধরনের আইনসমূহ এনজিওগুলির গঠন, ব্যবস্থাপনা ও আইনগত দায়দায়িত্ব সম্পর্কিত এবং এ ধরনের বিদ্যমান চারটি আইন হচ্ছে সোসাইটিজ রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্ট ১৮৬১, ট্রাস্ট অ্যাক্ট ১৮৮২, কোঅপারেটিভ সোসাইটিজ রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্ট ১৯২৫ এবং কোম্পানি আইন ১৯৯৪। দ্বিতীয় ধরনের আইনসমূহের মধ্যে আছে স্বেচ্ছাসেবী সমাজকল্যাণ সংস্থা (নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাদেশ ১৯৬১, বিদেশি অনুদান (স্বেচ্ছাসেবা কার্যক্রম) নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ ১৯৭৮ (১৯৮২-তে সংশোধিত) এবং বিদেশি চাঁদা/অর্থসাহায্য (নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাদেশ ১৯৮২। বিদ্যমান আইন, বিধিবিধান ও অধ্যাদেশসমূহে প্রদত্ত সংজ্ঞাগুলিতে অস্পষ্টতা এবং কোনো ধরনের কাজ করা যাবে বা কোনো ধরনের কাজ করা যাবে না সে সম্পর্কে পরস্পরবিরোধী অনেক ধারা থাকায় এনজিও কার্যক্রম পরিচালনায় বহু অসুবিধা দেখা দিয়েছে। অধিকন্তু অধ্যাদেশ ও বিধিমালায় বেশকিছু ধারা এমনভাবে বর্ণিত আছে যে, প্রয়োজনে অংশগ্রহণমূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও কার্যক্রম পরিচালনার জন্য এনজিওগুলি যথেষ্ট নমনীয় হতে পারে না। এনজিও সংক্রান্ত আইন-কানুনের শিরোনাম দেখলেই বোঝা যায়, এগুলি মূলত এনজিওদের কার্যক্রম সুগম করে দেওয়ার চেয়ে বরং তা নিয়ন্ত্রণের জন্যই প্রণীত। ১৯৯৩ সালের এনজিও-বিষয়ক ব্যুরো ‘বিদেশি এবং বিদেশি সাহায্যপুষ্ট দেশি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাসমূহের কার্যপ্রণালী বিধি’ নামে একটি নির্দেশ জারি করে। এতে এনজিওদের কার্যক্রমে আইনগত জটিলতার কিছুটা সমাধান হয়।
বাংলাদেশে দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়নে, বিশেষ করে, দারিদ্র্য বিমোচন ও সমাজ-সেবা কার্যক্রমে স্থায়ী অগ্রগতি অর্জনে সরকারি উদ্যোগ পর্যাপ্ত নয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে সরকার এসব ক্ষেত্রে এনজিওগুলির সম্পূরক ভূমিকার স্বীকৃতি দিয়েছে এবং সরকার ও এনজিওগুলির পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নে বেশকিছু কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে, যেমন পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশন, এনজিও বিষয়ক ব্যুরো এবং সরকার-এনজিও পরামর্শ পরিষদ গঠন।
পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) ১৯৯০-এর মে মাসে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি প্রতিষ্ঠার প্রধান উদ্দেশ্য, দারিদ্র্য বিমোচনের লক্ষ্যে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম পরিচালনায় নিয়োজিত সম্ভাবনাময় এনজিওসমূহের অর্থসংস্থানে সাহায্য প্রদান। পিকেএসএফ নিজে কোম্পানি আইনের অধীনে নিবন্ধিত একটি অলাভজনক সংস্থা। ২০০৮ সালের জুন পর্যন্ত পিকেএসএফ ২২,৭০৮ মিলিয়ন টাকা ঋণ দিয়েছে। পিকেএসএফ-এর সাহায্যপুষ্ট এনজিওগুলি দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ৬২টি জেলাতেই কর্মরত। আর, পিকেএসএফ-এর অর্থ থেকে ঋণসুবিধা পেয়েছে ৭০ লক্ষেরও বেশি দরিদ্র ব্যক্তি, যাদের ৯২%-ই মহিলা। পিকেএসএফ-এর ঋণ আদায় হার ৯৮%। বর্তমানে এটি ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম সমন্বয়কারী একটি শীর্ষ প্রতিষ্ঠান এবং এশিয়ার বৃহত্তম ও সবচেয়ে সফল সংস্থা।
এনজিও-বিষয়ক ব্যুরো প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৯০ সালের জুলাই মাসে। এটি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য ছিল এনজিওসমূহের কার্যক্রমের গুণগত উৎকর্ষ এবং সরকারের নিকট এদের জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ। এ লক্ষ্যে পরিচালিত এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর কার্যাবলি হচ্ছে এনজিওসমূহের নিবন্ধন প্রদান, তাদের প্রকল্পসমূহ প্রক্রিয়াকরণ ও অনুমোদন; এনজিওগুলিতে বিদেশি কর্মকর্তা ও পরামর্শকদের নিয়োগ ও কার্যকাল অনুমোদন; এনজিও কার্যক্রমসমূহ সমন্বয়সাধন, পরিবীক্ষণ, পরিদর্শন ও মূল্যায়ন; এনজিওসমূহের প্রতিবেদন ও বিবরণীসমূহ পর্যালোচনা ও সেগুলির ওপর মন্তব্য প্রদান, এনজিওগুলি থেকে ফিস/সার্ভিস চার্জ আদায়; তাদের আয়-ব্যয় বিষয়ে মাঠ পর্যায়ে পরিদর্শন এবং এনজিও ও দাতাসংস্থাসমূহের মধ্যে সমন্বয় ও যোগাযোগ রক্ষা। এনজিও বিষয়ক ব্যুরো গঠনের পর আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতা ব্যাপক পরিমাণে কমে গেছে, কাগুজে কার্যক্রম তথা নথি প্রক্রিয়াকরণের বাহুল্য কমে এসেছে, হ্রাস পেয়েছে প্রকল্প অনুমোদনের প্রয়োজনীয় সময়। তবে অনেক ক্ষেত্রে প্রক্রিয়াগত দীর্ঘসূত্রতা রয়ে গেছে, দক্ষ লোকবল আর কাজের উপযোগী মানসিকতার অভাবে এনজিও-বিষয়ক ব্যুরো এখনও কাজেকর্মে তেমন দক্ষতা অর্জন করতে পারে নি।
সরকার এবং এনজিওসমূহের মধ্যে সরাসরি সংলাপ পরিচালনার ফোরাম হিসেবে সরকার-এনজিও পরামর্শ পরিষদ গঠিত হয় ১৯৯৬ সালে। এর লক্ষ্য সরকার ও এনজিওসমূহের মধ্যে সহযোগিতার ক্ষেত্রে যেসব বাধা আছে সেগুলি চিহ্নিত করা এবং আলোচনার মাধ্যমে সরকার-এনজিও সহযোগিতার জন্য উন্নত ও কার্যোপযোগী নীতি প্রণয়ন ও প্রাতিষ্ঠানিক পরিবেশ সৃষ্টি করা। এ ছাড়া, এ সংস্থার আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে, জাতীয় নীতি-নির্ধারণ ও সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পসমূহ বাস্তবায়নে এনজিওসমূহের ব্যাপক অংশগ্রহণের পদ্ধতি উদ্ভাবন, এনজিওগুলির কর্মকান্ড নিয়ন্ত্রণের যে সরকারি ব্যবস্থা আছে তার সহজকরণ ও উন্নতিবিধান এবং এনজিও-বিষয়ক ব্যুরোর পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন ক্ষমতা শক্তিশালীকরণ।
উপার্জনমূলক কার্যক্রম পরিচালনায় এনজিওসমূহের তৎপরতা মাঠ পর্যায়ে সরকারের পল্লী উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডের কার্যকর বিকল্প হিসেবে চিহ্নিত। তবে এসব কার্যক্রমে লাভের হার তুলনামূলকভাবে কম বলে অনেকেই এখন এ জাতীয় কার্যক্রমের স্থায়ী উপযোগিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। বস্ত্তত বাংলাদেশে এখন কোনো কোনো এনজিও উপার্জনমূলক কর্মকান্ডে ঋণ প্রদানের ধারণাটিই বাতিল করে দিয়েছে। পক্ষান্তরে তারা ভূমি, বনাঞ্চল, জলাভূমি ইত্যাদির উপর ভূমিহীনদের নিয়ন্ত্রণ বাড়ানো এবং সরকারি সেবা কার্যক্রমের সুবিধার ক্ষেত্রে তাদের যথাযথ দাবি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তাদেরকে সংগঠিত করার ওপর অগ্রাধিকার দেওয়ার পক্ষপাতি। বড় বড় বেশকটি এনজিও দু ধরনের কার্যক্রমই পরিচালনা করছে। তাদের যুক্তি হচ্ছে, উপার্জনমূলক কর্মকান্ডের শুধু অর্থনৈতিক সুবিধাই নেই, সামাজিক সুবিধাও অনেক, বিশেষ করে মহিলাদের ক্ষমতায়নে উপার্জনমূলক কর্মকান্ডের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
বিগত তিন দশকে বাংলাদেশে এনজিও কার্যক্রমসমূহ বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে সুসংগঠিতভাবে পরিচালিত হয়ে আসছে। এগুলি হচ্ছে তৃণমূল পর্যায়ে কার্যকর গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রচলন, দারিদ্র্য বিমোচন, নারী অধিকার, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা এবং পরিবেশ। বাংলাদেশে এনজিও তৎপরতা বস্ত্তত উন্নয়ন উপযোগিতা আছে এমন সকল খাতেই বিস্তৃত। দেশের এনজিওসমূহ নানা নবোদ্ভাবনার জন্য বিশ্ব জুড়ে পরিচিতি লাভ করেছে। উল্লেখযোগ্য নবোদ্ভাবনার মধ্যে আছে ক্ষুদ্রঋণ, অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা-য় গ্রামীণ ব্যাংক, ব্র্যাক ও আশা-র অনুসৃত মডেলসমূহ। এনজিওসমূহ এখন সমাজজীবনে পরিবর্তন আনয়নে সক্ষম এমন অনেক নতুন নতুন কার্যক্রম ও কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে আসছে, নানারকম নতুন ধারণা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছে।
বাংলাদেশে কর্মরত এনজিওসমূহ দ্রুত ক্রমবর্ধিত পরিমাণে বিদেশি অনুদান পাওয়ায় এবং তাদের কাজের ক্ষেত্র ও ভৌগোলিক পরিসর ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হওয়ায় এনজিওদেরকে সরকার কখনও কখনও নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবে। তবে এনজিও ও সরকারি সংস্থার একে অপরকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবার কোনো কারণ নেই। বরং উভয়ের মধ্যে কার্যকর সহযোগিতায় অনেক জনহিতকর কার্যক্রম সফলভাবে পরিচালনা করা সম্ভব। এর জন্য প্রয়োজন সরকারি সংস্থা ও এনজিওসমূহের মধ্যে যোগাযোগ এবং সমন্বয়ের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা। [সালেহউদ্দিন আহমেদ]
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস